প্রসঙ্গ : গ্লোবাল ওয়ার্মিং Global Warming!

প্রসঙ্গ : গ্লোবাল ওয়ার্মিং
~সুমেরু রায়

‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ সমস্যার সমাধান করতে হলে, প্রথমেই এর কারণগুলিকে জানতে হবে আমাদের। ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’-এর পিছনে বিপুল পরিমানে ধোঁয়া–ধুলো দুষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানীর ব্যবহার অন্যতম প্রধাণ কারন হলেও, একমাত্র কারন নয়। বিভিন্ন সময়ে– বিভিন্ন প্রকারের একাধিক কারণ থাকতে পারে এর পিছনে। পৃথিবী প্রতিনিয়ত নির্দিষ্ট পরিমানে তাপ মোক্ষণ করে বলেই, জীবের পক্ষে স্বাচ্ছন্দকর তাপমাত্রা বজায় থাকে। এই তাপ মোক্ষণে সহায়তা করে তার আবহমন্ডল। কোনো কারণে এই তাপ মোক্ষণে অনিয়ম –ব্যতীক্রম হলেই, ঘটতে পারে ঊষ্ণায়ন, এমন কি হিমায়ণ-ও।

পৃথিবীর উপরিভাগের তাপের প্রধান উৎসগুলি হলো–

১। সূর্যালোক
২। পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থিত বা উদরস্থ তাপের একটা অংশ, যা বহীর্মুখী হয়ে পৃথিবীর উপরিভাগে এসে পৌঁছায়।
৩। নানাবিধ দাহ্যবস্তু বা জ্বালানি হতে উৎপন্ন তাপ। যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪। বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি, যা ঘর্ষণের মধ্য দিয়ে তাপ রূপে প্রকাশলাভ ক’রে থাকে।
৫। বিদ্যুৎ হতে উৎপন্ন তাপ।
৬। অসংখ্য জীবশরীরে সর্বক্ষণ যে তাপ সৃষ্টি হচ্ছে– তার পরিমানও কম নয়। অনুজীব দ্বারা ফার্মাণ্টেশন প্রক্রিয়াতেও প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। জীবের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথেসাথে পৃথিবীর তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পৃথিবীর উপরিভাগের তাপের একটা বড় অংশ হলো– সমুদ্রের জলের তাপ। প্রধাণত, সমুদ্রের জল উত্তপ্ত হয়– সূর্যালোক থেকে, পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ তাপ থেকে, সমুদ্রের জলের মধ্যে ঘর্ষণ হতে উৎপন্ন তাপ থেকে, এবং জলজ উদ্ভিদ ও জীবকূল থেকে উৎপন্ন তাপ থেকে।

সমুদ্রের উপরিভাগের উত্তাপ বেশি হয়– তাপের ঊর্ধগামী ধর্মের কারণে, এবং সূর্যালোকে উত্তপ্ত হওয়ার কারণে। সমুদ্রের জলের তাপ– তলদেশের দিকে ক্রমশই কম হয়। অর্থাৎ সমুদ্রের নীচের জল ক্রমশই শীতল।
পৃথিবীর উপরিভাগের তাপের হ্রাস-বৃদ্ধি —পৃথিবীর ঊর্ধে অবস্থিত বিভিন্ন স্তরের আবহমন্ডল বা এটমস্ফিয়ারের অবস্থার উপর এবং সেই আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলিতে উপস্থিত বহিরাগত কণাদের গুণ বা চারিত্রিক বৈশিষ্টের উপর অনেকটাই নির্ভর করে।

পৃথিবীর জলভাগের উপরিতল এবং তুষারাচ্ছাদিত বিশাল অংশ— সূর্যালোককে প্রতিফলিত ক’রে ঊর্ধাকাশে নিক্ষেপ করার ফলে, সূর্যালোকের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা খুব বেশি বৃদ্ধি পেতে পারেনা। যদিনা সে তাপ অনেকাংশে পৃথিবীর ঊর্ধে অবস্থিত বিভিন্ন আবহমন্ডল থেকে প্রতিফলিত হয়ে পুণরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে। পৃথিবীর তাপ বৃদ্ধির পিছনে এটাও একটা বড় কারণ।  

পৃথিবীর ঊর্ধে অবস্থিত আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলি যদি এমন হয়, এবং সেইসব স্তরগুলিতে যদি এমন কোনো বা কিছু বহিরাগত কণা অধিক সংখ্যায় উপস্থিত থাকে, যা—   

১। পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে ঊর্ধগত তাপকে অনেকাংশে পুণরায় পৃথিবীতেই ফিরিয়ে দেয়। অর্থাৎ পৃথিবীর তাপ যদি আবহমন্ডলে অথবা আবহমন্ডলে উপস্থিত সেইসব কণায় প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসে, তাহলে— পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে।
২। আবহমন্ডলের কণাগুলি শুভ্র তুষারকণার মতো, সূর্যালোককে মহাকাশে নিক্ষেপ করার ফলে, যদি সূর্যের তাপ পৃথিবীতে প্রবেশ করতে অক্ষম হয়, তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যাবে।
৩। আবহমন্ডল যদি ফিল্টারের মতো সূর্যালোক থেকে তাপ শুষে নেয়, তাহলে প্রথমদিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে গেলেও, পরে ঐ তাপ পৃথিবীতে নেমে এসে— পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
৪। পৃথিবীর ঊর্ধে অবস্থিত আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলি যদি সূর্যালোককে অধিক পরিমাণে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে দেয়, তাহলেও পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে।
৫। পৃথিবী থেকে ঊর্ধগামী তাপ— ঊর্ধে অবস্থিত আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলিতে বিশেষ বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে যদি অধিক অংশেই বহীর্মুক্ত হতে পারে, তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যাবে।
৬। পৃথিবী থেকে ঊর্ধগামী তাপ যদি ঊর্ধে অবস্থিত আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলি শুষে নেয়, তাহলে প্রথম দিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে গেলেও, পরে ঐ তাপ পৃথিবীতে নেমে এসে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
৭। গ্রীণহাউস গ্যাস --যা তাপ শোষণ করে এবং নানা বস্তুকণা যারা তাপ শোষণ করে, এরা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।

এছাড়া, আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলিতে জলকণা— জলীয়বাষ্প বা মেঘ— বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন কান্ড ঘটাতে পারে। আবার, তা’ যদি হয় দুষণযুক্ত, সেক্ষেত্রে দুষণের মাত্রা ও প্রকৃতিভেদে নানা প্রকার ঘটনা ঘটতে পারে। কখনো বা কোনো অবস্থায় তাপ বাড়তে পারে, কখনো বা কোনো অবস্থায় তাপ কমতে পারে। তবে সাধারণত, আবহমন্ডলে জলীয়বাষ্পের আধিক্য পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে।
এছাড়াও, নিম্নচাপ— ঘূর্ণিঝড় বা ঘূর্ণাবর্ত, বৃষ্টিপাত ও তুষারপাতের মতো ঘটনাগুলিও তাপের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। পৃথিবীর তাপের হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ফ্যাক্টর হলো— এককোষীয় উদ্ভিদসহ সর্বপ্রকার উদ্ভিদ।

উপরোক্ত কারণ বা ঘটনাগুলির একাধিক কারণ বা ঘটনা যদি একত্রে সংযুক্ত হয়, অথবা সংঘটিত হয়, সেক্ষেত্রে নানা প্রকার ঘটনা ঘটতে পারে।  

পৃথিবীর ঊর্ধে অবস্থিত আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলির স্বাভাবিক আচরণে ব্যত্যয় ঘটে থাকে— তাদের বিকার-বিকৃতি ঘটার ফলে, দুষণের ফলে। আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলির বিকার-বিকৃতি ঘটার পিছনে, দুষণ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন কণার উপস্থিতির পিছনে প্রধান কারণগুলি হলো—

১) কাঠ, উদ্ভিজ্জ তেল, খনিজ তেল—গ্যাস, জীবাষ্ম প্রভৃতি দাহ্যবস্তুর দহন থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া এবং নানাবিধ গ্যাসসহ নানা বস্তুকণা। যেমন— কার্বন, নাইট্রোজেন এবং কার্বন ও সালফারের অক্সাইড প্রভৃতি। এর থেকে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াসা যা আবহমন্ডলের বিকার-বিকৃতি ঘটিয়ে থাকে।
২) বিভিন্ন বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন হওয়া ধোঁয়া এবং নানাবিধ গ্যাসসহ দুষণ সৃষ্টিকারী নানাবিধ বস্তুকণা। এর থেকে সৃষ্টি হতে পারে ধোঁয়াসা বা ‘স্মোকী ফগ’।
৩) আগ্নেয়গিরি থাকে নির্গত ধুলো— ধোঁয়া, নানাবিধ গ্যাসসহ নানাবিধ বস্তুকণা। এর থেকেও ঘন ধোঁয়াসা সৃষ্টি হয়, যা আবহমন্ডলকে দুষিত ক’রে তোলে— আবহমন্ডলের বিকার ঘটায়।
৪) বিভিন্ন প্রকারের বর্জ্য পদার্থ –রাসায়নিক পদার্থ ও গ্যাস, এবং তাদের বিক্রিয়া থেকে উৎপন্ন নানাবিধ রাসায়নিক গ্যাস এবং নানাবিধ বস্তু ও পদার্থ।
৫) হঠাৎ ক’রে ঘটা অথবা পূর্বনির্ধারিত –অবশ্যম্ভাবী কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দুর্ঘটনা। যা ঘটতে পারে— মহাকাশের কোনো নক্ষত্র, গ্রহ, গ্রহানু, উপগ্রহ, ধুলিকণার দ্বারা অথবা কোনো বিশেষ শক্তির প্রভাবে। এছাড়া, পৃথিবীর অভ্যন্তরেও অনেক ঘটনা ঘটতে পারে।

এখন, আবহমন্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলিতে কী—কী ধরণের দুষণ এবং অস্বাভাবিকতা ঘটেছে এবং ঘটতে চলেছে, তা’ পরীক্ষা ক’রে দেখতে হবে। আবহমন্ডলে কোনোরূপ বিকার-বিকৃতি ঘটেছে বা ঘটছে কিনা তা’ ভালভাবে অনুসন্ধান করতে হবে— নিয়মিতভাবে। সমস্যার প্রকৃতি এবং তার কারণ জানতে পারলে, তার সমাধান করা অনেক সহজ হবে।

পৃথিবীর দুষণ এবং তাপমাত্রা অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পেলে, তখন সমস্ত সিস্টেমটাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা বিনষ্ট হয়ে পড়বে, এবং তার ফলে গ্লোবাল রেফ্রিজারেশন বা হিমায়ন প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যেতে পারে। এছাড়া, পৃথিবীতে বহিরাগত সংঘাত বা বিপর্যয়ের ফলেও ঊষ্ণায়ন বা হিমায়ন ঘটতে পারে। পৃথিবীর কক্ষপথের বিচ্যুতি ঘটলেও ঊষ্ণায়ণ বা হিমায়ন ঘটতে পারে।

গ্লোবাল হিমায়ন তখনই সংঘটিত হবে , যখন যথেষ্ট পরিমানে সূর্যালোক পৃথিবীতে পেওবেশ করতে অক্ষম হবে। আর, কিছুটা প্রবেশ করলেও, তা’ প্রতিফলিত হয়ে মহাশূণ্যে ফিরে যাবে। এবং/অথবা পৃথিবীর নিজস্ব তাপ বিনা বাধায় বিমুক্ত হয়ে— মহাশূণ্যে চলে যাবে। পৃথিবীর নিজস্ব ব্যবস্থা বা সিস্টেম কোলাপ্স হয়ে গিয়েও পৃথিবী হিমায়িত হতে পারে। তবে হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে, সেই অবস্থা আসতে এখনো বহু দেরী।

পৃথিবীর মতোই, আভ্যন্তরীণ কারণে এবং আবহমন্ডলের কারণে অথবা বহীর্জাগতিক কারণে, আবার কখনো উভয় কারণেই আমাদের শরীরের তাপমাত্রা কখনো বৃদ্ধি পায়— কখনো হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। আমাদের শরীরের পক্ষে স্বাচ্ছন্দকর— আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় রাখতে, আমরা কখনো স্নান করি, কখনো ঘরের জানালা খুলে দিই, আবার কখনো বন্ধ ক’রে দিই। প্রয়োজনে কখনো শরীরকে কোনো আবরণ দিয়ে আবৃত করি, আবার কখনো আবরণ মুক্তক’রে দিই। আমরা পৃথিবী তথা প্রকৃতিরই একটা অংশ। আমাদের শরীরসহ পৃথিবীকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে পরিবেশ ও আবহমন্ডলের উপরেও নিয়ন্ত্রণলাভ করতে হবে আমাদের।           



Comments

Popular posts from this blog

S-Existence and its Contrary Existence

অত্যাধিক যৌন উত্তেজনা ও উন্মাদনা মানবসমাজের এক জ্বলন্ত সমস্যা! ~মহর্ষি মহামানস

ধর্ষণ : এক জ্বলন্ত সমস্যা এবং তার সমাধান