সময় আমার সময়

।। সময় আমার সময় ।। (১ম পর্ব)
~মহর্ষি মহামানস (সুমেরু রায়)



মন যেমন মস্তিষ্কের ক্রিয়া হতে উৎপন্ন একটি অস্তিত্ব, তেমনই সময়ও--- যে কোন রূপ ক্রিয়া হতে উৎপন্ন এক বিশেষ অস্তিত্ব। দৃশ‍্যতঃ অস্তিত্বহীন এক অস্তিত্ব।

 ক্রিয়া থাকলেই তা' থেকে সময় সৃষ্টি হবে, --- সেই ক্রিয়ার নিজস্ব সময়। আর ক্রিয়া যদি নিয়ম-শৃংখলার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট গতিতে এবং নির্দিষ্ট পথে চক্রাকারে--- অবিরামভাবে পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়ে চলে,  তখনই সৃষ্টি হয় বোধযোগ্য এবং পরিমাপযোগ্য সময়। এই রূপ সময়ের ভিত্তিতে অপরাপর বস্তু--- ব্যক্তি প্রভৃতির ক্রিয়াকাল এবং জীবৎকাল পরিমাপ করা যায়।

সংক্ষেপে, পৃথিবীর ঘূর্ণন ক্রিয়া অথবা ঐরূপ চক্রাকারে (লুপ) ঘটে চলা কোনো ক্রিয়ার বিভিন্ন ভাগ বা অংশ বা পর্ব গুলিকে অথবা সমগ্র অংশকে বোঝার ও বোঝানোর সুবিধার্থে ক্রিয়াকাল রূপে একটি অস্তিত্বের কল্পনা করে, তাকে 'সময়' নামে অভিহিত করা হয়েছে।

কোন কিছুর জীবৎকাল বা আয়ুষ্কাল অথবা বয়স বলতে, সাধারণভাবে--- তার জন্ম থেকে মৃত্যু বা সৃষ্টি থেকে লয়, অথবা আয়ুষ্কালের একটি নির্দিষ্ট অংশ পর্যন্ত, পৃথিবীর (নিয়মিত গতিরূপ ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত--- পরিমাপযোগ্য) সময়ের হিসাবে ---তার স্থায়িত্বকাল টুকু বোঝায়। প্রত্যেকটি বস্তু, পদার্থ ও জীবের নিজস্ব ক্রিয়া আছে এবং (পৃথিবী বা অন্য কারো সময়ের হিসাবের মধ্যে থাকলেও) আছে তার নিজস্ব সময়।

 ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা যখন 'সকাল ---সন্ধ্যা' বলি,  তখন শুধু সময়কেই বোঝাই না, ---সেই নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত চক্রাকারে ঘটে চলা বিশেষ কোনো এক বা একগুচ্ছ প্রাকৃতিক এবং তৎসম্পর্কিত অন্যান্য ক্রিয়া বা ঘটনা, পরিবেশ ও পরিস্থিতিকেও সময় বা সময়ের দ‍্যোতক রূপে গণ্য করে থাকি।

 সময়কে তার এক এক পর্বে, এক একটি বিশেষ রূপে দেখতে অভ্যস্ত আমরা। ওই রূপটাই আমাদের কাছে সময় রূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু প্রকৃতই সময়ের কোন রূপ নেই। ঘটনাক্রমে--- সময়ান্তরে প্রকৃতির পরিবর্তিত রূপ থেকেই আমাদের সময়ের ধারণা জন্মায়।

বলা হয়---, সময়ের ছাপ, সময়ের ক্ষমতা, সময়ের দান প্রভৃতি। যেন, সময়ের নিজস্ব কোন শক্তি বা ক্ষমতা আছে, যার দ্বারা সে অনেক কিছু করতে পারে। বাস্তবে সময়ের স্বাধীন কোন রূপ- গুণ- ক্ষমতা নেই। অবিরাম কার্যক্রমের বা ঘটনাক্রমের ধারায়, একের পর এক নানা ক্রিয়া বা নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহের--- এক একটি পর্বে এক একটি বিশেষ রূপ, বিশেষ ক্ষতি বা প্রাপ্তি ঘটে থাকে। সেগুলিকে আমরা সময়ের মাপে ফেলে, ঘটনা পরম্পরাকে আমাদের ধারণার মধ্যে এনে থাকি। বলে থাকি, 'যে সময়ে যা ঘটার তাই ঘটবে,  সময় হলেই ঘটবে'....ইত্যাদি। কিন্তু তার মানে এই নয়, যে, সময়ই এই ঘটনা গুলি ঘটাচ্ছে। সময় যে একটা শক্তিশালী অস্তিত্ব তা' বাস্তবে এখনো প্রমাণিত হয়নি।

এই প্রসঙ্গে বলি, সময়ের মত ভাগ্যও ক্রিয়া হতে উদ্ভূত--- আপাতদৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন এক বিশেষ অস্তিত্ব। সৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এরা অর্থাৎ জাগতিক সময় ও ভাগ্য--- উভয়েই অস্তিত্ত্ব সম্পন্ন হয়ে ওঠে।

আমরা কতটা গতিসম্পন্ন? আমাদের সক্রিয়তা--- গতিশীলতা ছাড়াও, আমরা পৃথিবীর গতির অধীনে আছি। শুধু পৃথিবী নয় সৌরজগতের গতির সাথে আমরা যুক্ত আছি। আবার, আমাদের নীহারিকাসহ সমগ্র মহাজাগতিক গতির মধ্য দিয়ে আমরা অভাবনীয় গতিতে গতিময়।

উচ্চ সক্রিয়তা বা দ্রুতগতিসম্পন্ন কোন বস্তু বা জীব--- নিম্ন সক্রিয়তা বা বিলম্বিত গতিসম্পন্ন সম-জাতীয় বস্তু বা জীবের তুলনায়  (কোনো অনিয়ম বা অঘটন না ঘটলে) অনেক পূর্বেই তার নির্দিষ্ট কার্য সম্পন্ন করবে, লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, পরিণতি লাভ করবে, ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, বুড়িয়ে যাবে এবং ফুরিয়ে যাবে বা লয় প্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ তার জীবনকাল হবে অপরটির তুলনায় অনেক কম, তার নিজস্ব সময়ের ভিত্তিতে দ্রুত বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে।

তবে, অধিক আয়ুষ্কালের কোন জীব বা মানুষ যদি উচ্চ সক্রিয়তা সম্পন্ন হয়, সেক্ষেত্রে সে দ্রুত বুড়িয়ে যাবে না, যদিনা সে কোন রোগ-ব্যধির দ্বারা আক্রান্ত হয়, যদিনা প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় প্রভৃতির অভাব ঘটে, এবং অঘটন কিছু না ঘটে।

তবে, প্রচলিত বৈজ্ঞানিক সূত্র বলছে, কোনো বস্তু বা ব্যক্তির সক্রিয়তা বা গতি যদি দ্রুততম হয়ে--- আলোর গতির নিকটবর্তী হয়, তখন তার সময় চলতে থাকবে খুব ধীরগতিতে। ফলতঃ তার বয়সও অতি ধীর গতিতে বাড়তে থাকবে। যদি না কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তার জীবনকাল বা আয়ুষ্কাল হবে সাধারণ গতি সম্পন্ন অনুরূপ বস্তু বা ব‍্যক্তির তুলনায় অনেকগুণ বেশি। যদিও, কোন বস্তু আলোর গতির সমান গতি লাভ করলে, তখন তার আর বস্তুরূপ অস্তিত্ব থাকবে না।

উচ্চতর চেতন স্তর থেকে উচ্চতম চেতন স্তরে--- সময় ক্রমশ খুব বেশি ধীর গতিশীল। পরমাত্মার নিদ্রাভঙ্গ কালের পর থেকে নিদ্রারম্ভ কালের পূর্ব পর্যন্ত, অর্থাৎ তার একটি দিন (মহাবিশ্বের সৃষ্টি--- স্থিতি--- গতি লয়) আমাদের পৃথিবীর কাল অনুসারে তা' কোটি কোটি বছরের সমান। (সৃষ্টি তত্ত্ব দ্রষ্টব্য)

মহা-সৃষ্টিতত্ত্বে আমরা দেখেছি, শুরুতেই সব নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। কোথায় কি ঘটবে, কখন কি ঘটবে। সৃষ্টি শুরুর সাথে সাথে ঈশ্বর বা মহাবিশ্বের কালচক্রের চলা শুরু হয়ে গেছে।

তোমার জন্মের সাথে সাথে, তোমার কালের ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করে দিয়েছে। একটি যন্ত্র তৈরি হওয়ার পর নির্দিষ্ট হয়ে যায়, (পরিবেশ পরিস্থিতি ও তার উপাদান সাপেক্ষে) কতকাল সে সার্ভিস দেবে এবং কতকাল সে তার স্বাতন্ত্র‍্য‍ নিয়ে টিকে থাকবে। আমাদের শরীর যন্ত্রের ক্ষেত্রেও তেমনই। 




প্রসঙ্গ: সময় (২য় পর্ব)

কোনকিছুর গতি বা সক্রিয়তা থেকেই 'সময়' নামে একটি ভার্চুয়াল অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়। মহাজাগতিক সময়ের জন্ম হয়েছে, মহাবিস্ফোরণের ( Big Bang) মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই।

প্রত‍্যেকটি গতিশীল বা সক্রিয় বস্তুর নিজস্ব সময় আছে। আমরা পৃথিবীর সময়ের অধীনে হলেও, আমাদের প্রত‍্যেকেরই আছে নিজস্ব সময়। একজনের সক্রিয়তার উপরেই তার নিজস্ব সময় সৃষ্টি হয়।

সময় হলো~ কোনো দুটি ঘটনার (অথবা কোনো ধারাবাহিক ঘটনার দুটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার) মধ্যবর্তী দূরত্ব বা ব্যবধান। যা আমরা নির্দিষ্ট গতিতে নিয়মিতভাবে সংঘটিত কোন ঘটনা হতে উদ্ভূত পরিমাপবোধক সময় নামক এক ভার্চুয়াল অস্তিত্বের ভিত্তিতে উপলব্ধি করে থাকি। যেমন, পৃথিবীর নিয়মিত আবর্তন থেকে উৎপন্ন হওয়া সময়ের ভিত্তিতে আমরা কোনো ঘটনার সময় নির্ধারণ করে থাকি।

সময় কি শুধুই মানুষের মনোগত বা ধারণাগত একটা অস্তিত্ব, নাকি তার বাস্তবতা-ও আছে! কেউ উপলব্ধি করুক আর নাই করুক, সময় তার নিজস্ব অস্তিত্বে বিরাজমান। বরং কখনো কখনো সময় সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভ্রান্ত হতে পারে। কখনো অল্প সময়কে কারোকাছে অনেক সময় বলে মনে হতে পারে। আবার তার বিপরীতও হতে পারে।
যেমন কোনো চক্র খুব দ্রুত বেগে ঘুরতে থাকলে, কোনো দর্শকের মনে হতে পারে, চক্রটি ধীরগতিতে ঘুরছে, এবং/অথবা বিপরীত দিকে ঘুরছে। এটা হলো দর্শকের দৃষ্টি বিভ্রম বা তার ভ্রান্ত ধারণা। বাস্তব তা নয়।

কোন বস্তু বা কোনকিছু মন্থর অথবা দ্রুতগতিসম্পন্ন হলে, তার কোন একটি (ঘটনার) অবস্থান থেকে অপর একটি (ঘটনার) অবস্থানে পৌঁছাতে (নিয়মিত গতিশীল অপর একটি ঘটনা থেকে উৎপন্ন পরিমাপযোগ্য সময়ের ভিত্তিতে দীর্ঘ সময় অথবা অল্প সময় ব্যয় হতে পারে।

ওই গতিশীল বস্তুটির নিজস্ব সময় কিন্তু তার ঐ গতির উপরেই নির্ভরশীল। সেখানে, তার গতি মন্থর হলে, তার সময়ও মন্থর হবে। তার গতি দ্রুত হলে, তার সময়ও দ্রুত হবে। এর ব্যতিক্রম বা বিপরীত হবে না। অর্থাৎ তার গতি দ্রুত হলে, তার সময় মন্থর হয়ে যাবেনা।

আপেক্ষিকতা দুই প্রকারের। প্রথমটি হলো, একাধিক বিষয়বস্তুর মধ্যে তুলনামূলক বিচার। আর দ্বিতীয়টি হলো, কোনকিছুর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায়, তার নিজের সঙ্গে নিজের তুলনামূলক বিচার।

আমি এখানে যে আপেক্ষিকতার উল্লেখ করছি, তা হলো কোনকিছুর নিজের সঙ্গে নিজের আপেক্ষিকতা। এখানে উচ্চ গতিশীল কোনকিছুর সঙ্গে তারই অপেক্ষাকৃত নিম্ন গতিসম্পন্ন অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।

কোনকিছুর সময় মন্থর হওয়ার অর্থ তার আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়া। সাধারণত, কারও গতি যদি আগের চেয়ে বেশি বা দ্রুত হয়, তবে তার সময়ের গতিও আগের চাইতে আরও দ্রুত হবে। এবং ফলস্বরূপ, তার আয়ু হ্রাস পাবে। বস্তুর গতি বা সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে, বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার কারণে তার আয়ুষ্কাল কমে যাবে।

তবে আইনস্টাইনের মতে, কোনও কিছু যদি আগের চাইতে দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়, তবে তার সময় হ্রাস পাবে এবং তার আয়ু বৃদ্ধি পাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তার নিজের গতি হ্রাস না হলে, কী করে তার (নিজস্ব) সময় মন্থর হয়ে যায়!

কোন বস্তু বা কোনকিছু মন্থর অথবা দ্রুতগতিসম্পন্ন হলে, তার কোন একটি (ঘটনার) অবস্থা থেকে অপর একটি (ঘটনার) অবস্থায় পৌঁছাতে (নিয়মিত গতিশীল অপর একটি ঘটনা থেকে উৎপন্ন পরিমাপযোগ্য সময়ের ভিত্তিতে) দীর্ঘ সময় অথবা অল্প সময় ব্যয় হতে পারে।

ওই গতিশীল বস্তুটির নিজস্ব সময় কিন্তু তার ঐ গতির উপরেই নির্ভরশীল। সেখানে, তার গতি মন্থর হলে, তার সময়ও মন্থর হবে। তার গতি দ্রুত হলে, তার সময়ও দ্রুত হবে। এর ব্যতিক্রম বা বিপরীত হবে না। অর্থাৎ তার গতি দ্রুত হলে, তার সময় মন্থর হয়ে যাবেনা।

কোন গতিশীল বস্তুর উপর বাইরের কোনোরূপ বল বা শক্তি প্রযুক্ত না হলে, বস্তুর গতি হতে উৎপন্ন 'সময়' স্বাভাবিকই থাকবে। তার সময় মন্থর হয়ে যাবে না।

কোন বস্তু যদি মহাশূন্য পথে (যদিও প্রকৃতপক্ষে শূন্য নয়) গতিশীল থাকে, সেক্ষেত্রে তার ক্ষয়ক্ষতি কম হবে অথবা হবেনা। তার আয়ু প্রায় একই থাকবে, অথবা তার আয়ু তেমন কমবে না। এটাই সাধারণ ধারণা।

কিন্তু বস্তুটী খুব দ্রুতগতি সম্পন্ন হলে, তার আকর্ষণ ক্ষমতা বেশি হবে, তার 'গ্র‍্যাভিটি' বেশি হবে। তারফলে, প্রচুর মহাজাগতিক কণা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর তাতে তার গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।

সেই উচ্চগতি সম্পন্ন বস্তুটি ক্রমশই মহাজাগতিক কণায় ভরে উঠতে থাকবে। অর্থাৎ তার মধ্যে মহাজাগতিক কণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এবং বস্তুটির স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকবে ক্রমশই।

এর ফলে ক্রমশই সেই বস্তুটীর আয়ুষ্কাল কমতে থাকবে। আর আয়ুষ্কাল যত কমতে থাকবে, তার সময় ততই দ্রুততর হবে। দ্রুত ফুরিয়ে আসবে তার সময়।

প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনকিছুর গ্র‍্যাভিটি যত বেশি হবে, তার সময় ততই মন্থর হতে থাকবে। কিন্তু সেই বস্তুটির মধ্যে যদি আত্মরক্ষার ব‍্যবস্থা না থাকে, যদি সে মহাজাগতিক এনার্জি বা কণা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, সেক্ষেত্রে তার আয়ুষ্কাল কমে যাবে। আর আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ার অর্থই হলো, তার (নিজস্ব) 'সময়' দ্রুতগতি সম্পন্ন হওয়া।

এই প্রসঙ্গে বলি, উচ্চতম গতিশীল আলোর ক্ষেত্রেও তার 'সময়' সৃষ্টি হয়ে থাকে। বহু দূরের গ‍্যালাক্সী থেকে পৃথিবীতে আসতে, আলোর অনেক সময় লাগে। তাই বলে, উচ্চতম গতির কারণে তার 'সময়' মন্থর হয়েছে, এমন কথা বলা যায়না।

আলো কোনও কালো বস্তুর উপর পতিত হলে, সে তার আলোক অস্তিত্ব হারাবে। এছাড়া, কোনো ঘরের সমস্ত দেওয়ালে আয়না বসানো থাকলেও, ঐ ঘরটি ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকিত করার পরে, যখন বাল্বটির সুইচ অফ করে, আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে, তখন ঐ ঘরে আর আলোর অস্তিত্ব থাকবে না।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার মূহূর্তেই টাইম, স্পেস এবং ডেসটিনি একইসঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে।
এই ভার্চুয়াল অস্তিত্ব গুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল হলেও এবং একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও এদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে।

সবশেষে বলি, 'সময়' নামে ভার্চুয়াল সত্তাটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই অস্তিত্ব সম্পন্ন হয়েছে। মহাবিশ্ব লয় প্রাপ্ত হলেই, 'সময়' অস্তিত্বেরও বিনাশ ঘটবে তখন।





।। সময় ও বয়স ।। (৩য় পর্ব)
~মহর্ষি মহামানস

এতক্ষণ সাধারণভাবে 'সময়' সম্পর্কে আলোচনা করলাম। এবার দেখা যাক, ধ্যান-আলোকে আর কি পাওয়া গেছে---।

মহাবিশ্বের প্রতিটি সক্রিয় বস্তু বা জীবের নিজস্ব সময় থাকলেও, সে মহাজাগতিক সময়ের অধীন। মহাজগতের মহা-ক্রিয়া থেমে নেই এক মুহূর্তও। নিরন্তর ক্রিয়া সংঘটিত হয়ে চলছে এখানে। আর এই অবিরাম মহা-ক্রীয়া-কান্ড থেকে উদ্ভূত মহাকাল-অস্তিত্বও থেমে নেই এক মুহূর্ত।

মনোময় সত্তার মতো সময়েরও আছে দিব‍্য অস্তিত্ব (দিব‍্য অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে, পড়ুন--- 'জীবাত্মা---দিব‍্যাত্মা')। 'মন' হলো স্নায়ুতন্ত্র এবং মস্তিষ্করূপ যন্ত্রের ক্রিয়া হতে উৎপন্ন এক বিশেষ অস্তিত্ব। মানসক্রিয়া--- মস্তিষ্করূপ যন্ত্রের ক্রিয়া হওয়া সত্ত্বেও, 'মন' রূপে তার একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, এবং আছে তার দিব্য-অস্তিত্বও।

সমস্ত ক্রিয়ার ক্ষেত্রেই, সেই ক্রিয়া থেকে উৎপন্ন 'সময়' অস্তিত্ব এবং তার দিব্যি-অস্তিত্ব, বস্তু ও শক্তির বাস্তব অস্তিত্ব এবং তার দিব‍্য অস্তিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। বস্তু ও শক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট হয়ে--- আবার ক্রিয়া শেষে বস্তু ও শক্তির সাথে মিশে যায়।

মহাজাগতিক ক্রিয়া অথবা অত্যন্ত শক্তিশালী দীর্ঘস্থায়ী কোন ক্রিয়ার ক্ষেত্রে, সেই মহা-ক্রিয়াকাণ্ড থেকে উদ্ভূত 'সময়' --স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পন্ন এবং মহাশক্তিশালী হয়ে থাকে।

অন্যান্য জীবের তুলনায় 'মানব-মন' যেমন---, তেমনি মহাজাগতিক সময়ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বে প্রকট--- প্রবল ক্ষমতাশালী এক 'সময়' অস্তিত্ব। ---মহাকাল অস্তিত্ব। কেবলমাত্র মহাজ্ঞানী, মহাযোগী এবং মহাবিজ্ঞানীদের দ্বারাই সে উপলব্ধ হয়ে থাকে।

পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার---। একটি জীব বা মানুষের ক্ষেত্রে, তার বয়স পৃথিবীর সময়ের মাপকাঠিতে মাপা হলেও, তার নিজস্ব সক্রিয়তার ভিত্তিতে--- নিজস্ব সময়ের গণ্ডিতে সে বাঁঁধা। যারা আয়ুষ্কাল একশো বছর (পৃথিবীর সময়ের পরিমাপে) সে দশ বছর বয়সে অল্পবয়স্ক কিশোর। আর যারা আয়ুষ্কাল পনের বছর সে দশ বছর বয়সে প্রৌঢ়।

অধিক আয়ুষ্কালের জীবদের ক্ষেত্রে অন্যান্য পর্বের মতো শৈশবও দীর্ঘহয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক হতেই লেগে যায় অনেক সময়। স্বল্প আয়ুষ্কালের জীবরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই খাদ্য সংগ্রহ এবং বংশ বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়ে ওঠে তারা। অতীতে মানুষের আয়ুষ্কাল বেশি, সক্রিয়তা ছিল এখনকার তুলনায় অনেক কম। এখন আয়ুষ্কাল কমে গেছে সক্রিয়তা বেড়েছে।

মূলতঃ সক্রিয়তার উপরেই--- বয়স, পরিপক্কতা, জ্ঞান-চেতনা ও বিকাশাদি নির্ভরশীল। পৃথিবীর সময় দিয়ে তার সঠিক পরিমাপ করা যাবে না। জীবের এই সক্রিয়তা শুধু আপাত জীবনের সক্রিয়তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। অতীতের অসংখ্য জীবনের সক্রিয়তা রয়েছে এর পিছনে।

বংশানুক্রমে অর্জিত পরিপক্কতা--- চেতনাদি আসলে, পূর্বপুরুষদের ঐসব জীবনে প্রাপ্ত শারীরিক অবস্থা, পরিবেশ- পরিস্থিতি এবং ঘটনাচক্র সাপেক্ষে সক্রিয়তা হতে উৎপন্ন পরম্পরাগত ফসল।

একটি জীবের সক্রিয়তা থেকে লব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা বংশানুক্রমে উত্তর-পুরুষদের মধ্যে সমানভাবে সঞ্চারিত হলে কোন কথাই ছিল না। সে ক্ষেত্রে সবারই বয়স, চেতনা, সক্রিয়তা হতো প্রায় সমান। কিন্তু তা ঘটেনি। যতদিন পর্যন্ত বিশুদ্ধ--- মৌলিক প্রকৃতির বা জাতির জীব ও উদ্ভিদ ---একই পরিবেশ-পরিস্থিতিতে নিজেদের স্ত্রী-পুরুষের মধ্যেই মিলন সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে, ততদিন কোন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। প্রত্যেকের নবজাতক বংশধরদের মধ্যে প্রায় সমান ভাবে সঞ্চারিত হয়েছে তাদের রূপ-গুণ-চেতনা, প্রকৃতি ইত্যাদি।

বিভিন্ন চেতন স্তরের ভিন্ন ভিন্ন মানব জাতি বা প্রকৃতির মধ্যে মিলন ঘটার পর থেকেই দেখা যায়, প্রতিটি নবজাতকের মধ্যে---   রূপ-গুণ-চেতনা-প্রকৃতি আর সমান ভাবে বিস্তার লাভ করছে না। দিনের পর দিন--- যত বেশি মিশ্রণ ঘটছে,ততই বৈচিত্র্যে ভরে উঠছে ধরিত্রী।

মৌলিক জাতির সক্রিয়তা একটি নির্দিষ্ট গতিতে--- নির্দিষ্ট বাঁধাধরা পথে, নির্দিষ্ট চরিত্রগত বা আচরণগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে, সেখানে চেতনার বিকাশও অতি সীমিত। ক্রমাগত মিশ্রণের ফলে বিভিন্ন প্রকৃতি, আকৃতি আচরণ, বৈশিষ্ট্য, গতি, চাহিদা ও চেতনা প্রভৃতির বিভিন্ন ভাগের সমন্বয়ে বহু বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধ চেতনাসম্পন্ন অতি সক্রিয় শংকর জাতির সৃষ্টি হয়ে চলেছে। ফলতঃ মানুষের মনের বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত হারে।

আপাতদৃষ্টিতে অনেকের মনে হতে পারে, উন্নতির চাইতে অবনতি-ই বেশি হচ্ছে। মানুষ এগিয়ে না গিয়ে--- যেন দিন দিন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে--- অবনতির দিকে। আসলে কিন্তু তা নয়, এখানে শুধু এগিয়ে চলাই আছে, পিছনো নেই। নেই থেমে থাকাও।


* 'সময়'-এর সঙ্গে 'ভাগ্য'-এর খুব নিকট সম্পর্ক রয়েছে। তাই, 'ভাগ্য' ও 'Destiny' -এর উপর আমার লেখা ব্লগ দুটি পড়তে অনুরোধ করছি।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

S-Existence and its Contrary Existence

অত্যাধিক যৌন উত্তেজনা ও উন্মাদনা মানবসমাজের এক জ্বলন্ত সমস্যা! ~মহর্ষি মহামানস

ধর্ষণ : এক জ্বলন্ত সমস্যা এবং তার সমাধান