বিশ্বাস কী ও কেন

বিশ্বাস কী ও কেন
 ~মহর্ষি মহামানস
 


যথেষ্ট যুক্তি-প্রমান ছাড়াই, সজাগ-সচেতন-মনের সাহায্যে সম্যকভাবে জানা ছাড়াই— অজ্ঞান-অন্ধত্ব— মোহমায়া বশতঃ কোনোকিছুকে সত্য বলে মেনে নেওয়া, ভ্রমাত্মক বা মায়াত্মক কোনো দর্শন — শ্রবনকে সত্য বলে মনে করা, অথবা কাল্পনিক কোনোকিছু সম্পর্কে স্থির নিশ্চয়াত্মক ধারণাই হলো ‘বিশ্বাস’। অন্যভাবে বলা যায়, ‘বিশ্বাস’ হলো— কোনোকিছু সম্পর্কে অজ্ঞান-অন্ধের মতো ধারণা লাভ করার জন্য অবচেতন মনের এক বিশেষ মানস-ক্রিয়া।


অবচেতন মন (আমাদের অধ্যাত্ম মনোবিজ্ঞানে— শিশুমন)-এর মানসক্রিয়া থেকে উদ্ভূত এক বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতাকে বলাহয় বিশ্বাসের শক্তি। ‘বিশ্বাস’ সুপথে চালিত হলে অথবা বিশ্বাসকে ভালো উদ্দেশ্যে— ভালো পথে চালিত করতে পারলে, অনেক ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। আবার অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে অথবা কারও হীন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তা’ বিপথে চালিত হলে— তখন তা’ অত্যন্ত কুফলদায়ক হয়ে থাকে।


বিশ্বাসের বিপরীত দিক— ‘অবিশ্বাস’ নয়। অবিশ্বাস-ও একপ্রকার বিশ্বাস। অন্যকিছুতে বিশ্বাস। বিশ্বাসের অপরদিকে থাকে জ্ঞান। কোনোকিছু সম্পর্কে সচেতন-মন (আমাদের অধ্যাত্ম মনোবিজ্ঞানে— কিশোরমন)-এর ধারণা লাভের মানসক্রিয়া এবং সেই ক্রিয়া হতে লব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব জ্ঞান। জানি বা জানিনা। ‘জানিনা’ –এও একপ্রকার জ্ঞান। নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা বা উপলব্ধি থাকলে, এবং সজাগ-সচেতন সত্যাশ্রয়ী হলে, তবেই বলা যায়— ‘জানিনা’। এই ‘জানিনা’-র কাছেই জানার দুয়ার খোলা থাকে।


‘বিশ্বাস’ হলো আমাদের জ্ঞান ও চেতনা লাভের পথে সবচাইতে বড় বাধা। মিথ্যা অহমিকা মুক্ত সজাগ-সচেতন মনে— ‘জানিনা’ শব্দটি থেকে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ‘জানিনা এবং জানতে চাই’ —এই ভাবনাটি আমাদের জানার পথকে প্রশস্ত করে তোলে। আর ‘বিশ্বাস’ সেই জানার পথকে রুদ্ধ করে রাখে।
 

বিশ্বাসের পিছনে থাকে সজাগ সচেতন-মনের অনুপস্থিতি, থাকে অজ্ঞান-অন্ধত্ব —জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতা। থাকে অহমিকা— মিথ্যা অহংবোধ। সেও এক বিশ্বাস। ‘বিশ্বাস’ কথাটির মধ্যেই অজ্ঞান-অন্ধত্ব প্রচ্ছন্ন থাকে। থাকে বিকশিত সচেতনমনের অনুপস্থিতি। তবুও যখন ‘অন্ধবিশ্বাস’ কথাটি বলা হয়, তখন বুঝতে হবে, সেখানে রয়েছে প্রগাঢ় অজ্ঞানতার অন্ধকার। খুব দৃঢ় এবং গভীর বিশ্বাস। যেখান থেকে একজন বিশ্বাসকারী কোনোভাবেই বেড়িয়ে আসতে পারেনা।


কোনোকিছু সম্পর্কে না জানা সত্বেও ‘আমি জানিনা’ —একথা স্বীকার করতে চায়না এই অহমিকা। সে নিজের অজ্ঞানতা— অক্ষমতাকে সহজভাবে মেনে নিতে অপারক। তা’ তার আত্মাভিমানকে আহত করে। তাই, সে তার এই অক্ষমতাকে চাপা দিয়ে রাখতে— অনেকসময় ‘বিশ্বাস’-এর আশ্রয় নিয়ে থাকে।


একজন স্বল্প-জ্ঞান ও স্বল্প-চেতন মানুষের পক্ষে বিশ্বাস ছাড়া এক পা-ও নড়া সম্ভব নয়। আবার সে যদি তার বিশ্বাসকেই দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে, জ্ঞানলাভে যদি তার অনীহা থাকে, তাহলে তার গতবিধি সেই খুঁটিতে বাঁধা গরুর মতোই সীমাবদ্ধ থাকবে। তার বেশি সে এগুতে পারবে না।


বিশ্বাসকে পরিপুষ্ট এবং প্রতিষ্ঠিত করে তোলার জন্য বিশ্বাসকারীদের একটা অতিসরল যুক্তি হলো— ‘এতো লোক যখন বলছে, তখন নিশ্চয়ই এর মধ্যে সত্য আছে’। তারা এটা ভেবে দেখেনা, সারা পৃথিবীর মানুষ যখন বিশ্বাস করতো— সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে, তখন গ্যালিলিওর মতো মাত্র কয়েকজন শুধু জানতো— সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। তাহলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা বা বিশ্বাস-ই যে সবসময় সত্য হবে, এমন কথা বলা যায়না।


বলা হয়ে থাকে, কারো বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবেনা— কারো বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া যাবেনা। কিন্তু না, সব ক্ষেত্রে এ’কথা খাটে না। তার সেই বিশ্বাস যদি অপর কারো পক্ষে ক্ষতিকর হয়, যদি তা’ মানুষ বা মানবজাতির পক্ষে হানিকর হয়, সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বলা যাবে। অবশ্যই প্রতিবাদ করা যাবে।
 

অজ্ঞান-অন্ধ মোহগ্রস্ত মানুষ— মনুষ্যেতর জীবের মতোই সহজপ্রবৃত্তির তাড়নায় কাজ করে থাকে। এই মানবজীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই— জানারও আগ্রহ নেই। অন্ধ-আবেগে মিথ্যার পিছনে ছুটে চলাই যেন তাদের জীবন। এর উপরে আবার রয়েছে— প্রচলিত ধর্ম এবং তদ্দ্বারা আরোপিত ধর্মীয় বিশ্বাস। এই ধর্মীয় বিশ্বাস হলো— মানুষকে অজ্ঞান-অন্ধ মুর্খ বানিয়ে রাখার এক গভীর ষড়যন্ত্র।
 

মানুষ যদি হাজার হাজার বছর ধরে, তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া— আরোপিত ধর্মবিশ্বাসের পিছনে না ছুটে, কোনোরূপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাডাই— শুধুমাত্র পৃথিবীর মুক্ত পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাহলে সে অনেক বেশি জ্ঞান ও চেতনা লাভ করতে পারতো। তা’ না হয়ে, হাজার হাজার বছর ধরে আরোপিত বিশ্বাসের পিছনে ছুটে চলার ফলে, মানুষের তেমন মনোবিকাশ ঘটেনি। সে আজ গভীরভাবে যুক্তি-বিচার ভিত্তিক মানসিক পরিশ্রম করতে গেলেই কাতর হয়ে পড়ে।


আসলে, জ্ঞান অর্জন করতে কিছু মানসিক পরিশ্রম করতে হয়, —বিশ্বাস করতে তো আর তার দরকার হয়না! তাই, মানুষ জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে জ্ঞানী হয়ে ওঠার শিক্ষার পরিবর্তে— বিশ্বাসী হয়ে ওঠার শিক্ষালাভেই বেশি আগ্রহী। সে মুখে সত্য চাইলেও, অন্তর থেকে চায়না। তার মনোভাব হলো— ‘ঝুটা হি সহি’ অথবা ‘…জাগিও না আমায় জাগিও না…’। আর তাই, মানবসমাজে বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষার এতো রমরমা বাজার।


আগেই বলেছি, বিশ্বাসের আছে অনেক শক্তি— অনেক ক্ষমতা। আর এই বিশ্বাসকে সম্বল করেই চতুর্দিকে ঘটে চলেছে বহু প্রতারণামূলক ঘটনা— বহু ঠকবাজীর ব্যবসা। তার মধ্যে প্রধান হলো— ধর্মব্যবসা। বিশ্বাসের প্রবল ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হলে, আধুনিক মনোবিজ্ঞানসহ আমাদের অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান ভালভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এ’নিয়ে ‘মন’ সম্পর্কীত প্রবন্ধে কিছুটা আলোচনা করেছি।
 

আমরা স্বল্প-জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন অসহায় মানুষ। এখনো আমাদের সচেতন-মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি। সাধারণত আমরা যাকে জ্ঞান ব’লে থাকি, তা’ অনেক সময়েই বিশ্বাস মিশ্রিত থাকে। আমাদের অনেক জ্ঞানই বিশ্বাস নির্ভর— বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তা’ গড়ে ওঠে। তাই আমাদের সমস্ত জ্ঞানই বিশুদ্ধ জ্ঞান নয়। ‘বিশ্বাস’ প্রসঙ্গে ‘জ্ঞান’ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। ‘জ্ঞান’ লাভ এবং ‘জ্ঞান’ হলো— সচেতন মনের এক বিশেষ মানসিক ক্রিয়ার দ্বারা কোনকিছু সম্পর্কে ধারণা লাভ, তথ্য ও তত্ত্ব গ্রহণ বা আহরণ, এবং সংগৃহীত সেই তথ্য ও তত্ত্ব ধারণার মানসিক ভান্ডার। সচেতন মনের বিকাশের উপর এই জ্ঞানের মাত্রা নির্ভরশীল। কারো মধ্যে সচেতন মন কম বিকশিত হলে, স্বভাবতই অবচেতন মনের কর্তৃত্ব সেখানে বেশি থাকে। এবং তার ফলে, তার ‘জ্ঞান’ হয় আংশিক ‘জ্ঞান’ এবং তা’ অনেকটাই বিশ্বাস মিশ্রিত এবং বিশ্বাস নির্ভর হয়ে থাকে।


যেহেতু আমাদের জ্ঞান ও চেতনা খুবই কম, তাই বিশ্বাস ছাড়া আমরা চলতে পারিনা। আবার এই বিশ্বাসই অধিকাংশ অনিষ্টের মূল কারণ। এমতো জটিল অবস্থায়, সবচাইতে ভালো উপায় হলো— সমস্ত জ্ঞানকে 'আপাত জ্ঞান' বা 'আপাত সত্য' রূপে গ্রহণ ক’রে, এবং সমস্ত বিশ্বাসকে 'আপাত বিশ্বাস' রূপে গণ্য করে— চোখ-কান খোলা রেখে, সজাগ-সচেতনভাবে যুক্তি-বিচারের পথ ধরে সত্যান্বেষণে এগিয়ে চলা। পর্যাপ্ত জ্ঞান ও চেতনা লাভ না হওয়া অবধি এইভাবেই চলতে হবে।


মনেরাখতে হবে, আমরা এখানে এসেছি এক শিক্ষামূলক ভ্রমনে। ক্রমশ উচ্চ থেকে আরও উচ্চ চেতনা লাভই —এই মানবজীবনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। এখানে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে যত বেশি চেতনা-সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবো, তত বেশি লাভবান হবো। মানবজীবন সার্থক হয়ে উঠবে তত বেশি।


প্রকৃতির নিয়মেই আমরা বিশ্বাস করে থাকি, বিশ্বাস না করে উপায় থাকেনা। আবার প্রকৃতির ব্যবস্থা মতোই আমরা একসময় বিশ্বাসের পর্যায় বা স্তর পার হয়ে— ক্রমে জ্ঞানের পথে এগিয়ে যাই। যেমন শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, কৈশোর পেরিয়ে যৌবন..., ঠিক তেমনভাবেই ক্রমে ক্রমে এগিয়ে চলা। যদিনা কোনো কারণে কেউ শৈশবে বা কৈশোরেই আটকে থাকে।
 

এই বিকাশ-পথটির মধ্যে কয়েকটি ধাপ বা পর্যায়ভাগ আছে। পুরোপুরি বিশ্বাসের স্তরটি হলো— শৈশব স্তর। তারপর জ্ঞান ও বিশ্বাসের মিশ্র স্তরটি হলো— কৈশোর। যৌবন হলো— যুক্তি-বিচার-প্রমানসহ জ্ঞান-পথ ধরে এগিয়ে চলার পর্যায় বা স্তর। এই স্তরে বিশ্বাসের উপস্থিতি খুবই কম। এর পরের স্তরটি হলো— প্রজ্ঞান স্তর। যৌবনের পর এই প্রৌঢ় পর্যায়ে— যুক্তি-বিচার-প্রমান ভিত্তিক জ্ঞানের প্রাধান্য কমে গিয়ে, ক্রমশ অন্তর্জ্ঞান— অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ ঘটতে থাকে। এই ভাবেই মনোপদ্মের পাঁপড়িগুলি একের পর এক স্তরে স্তরে বিকাশলাভ করতে থাকে, এবং সেই সঙ্গে আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে একসময় পূর্ণ বিকাশলাভ করতে সক্ষম হই। বর্তমানে আমরা কেউ শৈশবে— কেউ কৈশোর-চেতন স্তরে অবস্থান করছি। এখন বিশ্বাসের পথ পেরিয়ে এসে জ্ঞানের পথে অর্থাৎ যৌবনে বা মানব-চেতন-স্তরে পদার্পন ক’রে, পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠাই আমাদের লক্ষ্য।

________________________

'বিশ্বাস' সম্পর্কে মহর্ষি মহামানস -এর আরও লেখা পড়তে চাইলে, এই লিঙ্ক অনুসরণ করুণ> 

https://mahadharma.wixsite.com/book/chapter-2

Comments

Popular posts from this blog

S-Existence and its Contrary Existence

অত্যাধিক যৌন উত্তেজনা ও উন্মাদনা মানবসমাজের এক জ্বলন্ত সমস্যা! ~মহর্ষি মহামানস

ধর্ষণ : এক জ্বলন্ত সমস্যা এবং তার সমাধান