প্রসঙ্গ : মা-বাবা ও সন্তান এবং তাদের কর্তব্য

 



প্রসঙ্গ : মা-বাবা ও সন্তান এবং তাদের কর্তব্য

~মহর্ষি মহামানস

সন্তান বড় হয়ে মা-বাবার দায়িত্ব নেবে, মানুষের সমাজে এই ব‍্যবস্থা বহুকাল ধরে চলে আসছে। অন‍্যান‍্য জীবের মধ্যে এইরূপ দেখা যায়না। মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারা ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত~ সমস্যা মুক্ত করতেই এই ব‍্যবস্থার প্রচলন ঘটিয়েছে। আর এই ব‍্যবস্থাকে পাকাপোক্ত ক'রে তুলতে, মা-বাবাকেও সন্তানের প্রতি বিশেষ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। সন্তানকে সুস্থ, শিক্ষিত, সাবলম্বী ক'রে তোলাসহ নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হয়, এবং সর্বোপরি সন্তানকে যথেষ্ট বিকশিত মনের মানুষ ক'রে তোলার দায়িত্ব নিতে হয় বাবা-মাকে। সন্তানও একসময় মা-বাবা হবে, তখন তারাও এই ব‍্যবস্থার সুফল পেতে পারবে।  এছাড়াও আরেকটি ব‍্যবস্থা আছে, তা' হলো, ভবিষ্যতে মা-বাবার অর্থ-সম্পদ লাভ করতে পারবে তাদের সন্তান। 

এখন সমস্যা হলো, অনেক সন্তান তাদের বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি এই দায়িত্ব পালন করছে না। বহু ক্ষেত্রেই সমাজের এই ব‍্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না! কেন এর কারণটা কী! 

বিষয়টিকে ভালভাবে বুঝতে, সমস্যার মূলে পৌঁছাতে হলে, আমাদের আরেকটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। অধিকাংশ মানুষ সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে সহজ প্রবৃত্তির তাড়নায়। শরীরের চাহিদাসহ অবচেতন মনের অন্ধ-আবেগের দ্বারা চালিত হয়েই এই কাজ ক'রে থাকে তারা।  যথেষ্ট সজাগ-সচেতনভাবে সমস্ত বাস্তব দিকগুলো নিয়ে উচিত-অনুচিত ভেবে-চিন্তে, কিসে ভাবি সন্তানের মঙ্গল হবে সে' সম্পর্কে যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা ক'রে, সন্তানের জন্ম দিয়েছে, এবং সন্তান পালনের বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সন্তান পালন করেছে, এমন মানুষ হাজারেও একজন মিলবে কিনা সন্দেহ আছে।  আর এখান থেকেই সমস্যার শুরু।

মা-বাবা যদি নিজেরাই যথেষ্ট সজাগ-সচেতন, সুস্থ ও বিকশিত মনের মানুষ না হয়, অন্ধ বিশ্বাস এবং অন্ধ আবেগের বশবর্তী হয়, তারা সন্তানকে মানুষ ক'রে তুলবে কি ক'রে! অধিকাংশ মানুষই স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প চেতনা সম্পন্ন এবং অসুস্থ হওয়ায়, ঠিক যা করা উচিত, যা করলে উভয়পক্ষের মঙ্গল হবে, তা' তারা ক'রে উঠতে পারেনা। তারা যাকিছু করে, প্রায় সবই সহজ-প্রবৃত্তির দ্বারা এবং স্বার্থের দ্বারা চালিত হয়েই ক'রে থাকে।

অজ্ঞান-অসুস্থ কামার্ত মানুষ বিপথগামী হয়ে কঠিন সব যৌন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ-ব‍্যাধিকে অপচিকিৎসার দ্বারা অবদমিত ক'রে রাখার ফলে, তাদের সেই রোগ-ব‍্যাধি সংক্রামিত হচ্ছে তাদের সন্তানদের মধ্যেও। ফলে তারাও অসুস্থ বিকারগ্রস্ত মানুষ রূপেই জন্মগ্রহণ করছে। সুদীর্ঘ কাল ধরে ক্রমশ এইভাবে চলতে চলতে সুস্থ মানুষের দেখা মেলাই কঠিন হয়ে পড়েছে আজ। 

সেইসঙ্গে রয়েছে ধর্ম নামে অধর্মের জাঁতাকল, যা এইসব মানুষের দ্বারাই সৃষ্ট এবং পালিত-পোষিত হয়ে চলেছে যুগযুগ ধরে। প্রচলিত এই ধর্ম মানুষকে অজ্ঞান-অন্ধ ক'রে রেখেছে। এখন, এই পরিবেশ-পরিস্থিতিতে, এই মানুষের শরীর-মন হতে জন্ম নেওয়া সন্তানের কাছ থেকে তাই (দু-চারজন ব‍্যাতাক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া) বেশি কিছু আশা করাই বৃথা। 

যদিও সন্তানদের বশে রাখার আরও একটি ভালো ব‍্যবস্থা আছে এই সমাজে, তা' হলো অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধভক্তির খাঁচাকল। ধর্ম ও রাজতন্ত্রকে একেবারে তৃণমূল থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত ক'রে তুলতেই এই ব‍্যবস্থা পাকা করা হয়েছে।  মা-বাবা, রাজা ও পুরোহিত যেমনই হোক, তারা যা-ই করুক বা যত দোষই করুক না কেন, তাদের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য থাকতে হবে। তারা হলো (কাল্পনিক) ঈশ্বরের জীবন্ত রূপ। এই অন্ধবিশ্বাসের ফাঁদে পড়ে অনেক সন্তানই মা-বাবার প্রতি তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করে চলেছে। ভিতরে ভিতরে অপছন্দ~ বীতশ্রদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেকে তাদের দায়িত্ব পালন করছে এই মায়ার ফাঁদে পড়ে অথবা সামাজিক ব‍্যবস্থাকে অমান্য করতে না পেরে। 

'মা-বাবা' মানেই (কাল্পনিক) স্বর্গের দেবী বা সাক্ষাৎ  ঈশ্বর। এমন দৃঢ়মূল অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বহু সন্তানই তাদের মা-বাবার প্রতি কর্তব্য পালন করে চলেছে। এমনকি দেব-দেবী জ্ঞানে মা-বাবার পূজার্চনা করতেও দেখা যাবে অনেক জায়গায়। তবে সত্যিকারের ভালো মা-বাবা এবং তাদের ভালো সন্তানও রয়েছে এই মানব সমাজে।

স্বার্থ আর স্বার্থের সংঘাত নিয়েই মানুষের জগত গড়ে উঠেছে। আর এর মধ্যে আমাদের অবচেতন ও সচেতন ~এই দুটি মনের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। একদিকে রয়েছে মোহ-মায়া, অজ্ঞানতা-অন্ধত্ব, যুক্তি-বিচার বিহীন লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, অন্ধ-আবেগ, অন্ধভক্তিপূর্ণ স্বার্থ ও স্বার্থের সংঘাত। অপরদিকে রয়েছে যুক্তি-বিচার ও বিবেকবান সজাগ-সচেতন মনের স্বার্থ ও স্বার্থের সংঘাত। 

সন্তানের মুখে এমন কথা এখন হামেশাই শোনা যাচ্ছে, '....তাহলে জন্ম দিয়েছিলে কেন!?' .'....তোমরা আমাকে জন্ম দিয়ে আমার মাথা কিনে নাওনি!' '.....তোমরা আমাকে জন্ম না দিলে, এতো দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা আমাকে ভোগ করতে হতো না।' '.....তোমাদের ইচ্ছামতো তোমরা আমাকে তৈরি করোনি। আমার রূপ-গুণ, জ্ঞান-বুদ্ধি কোনো কিছুই তোমাদের ইচ্ছামতো সৃষ্টি হয়নি , তাই তোমাদের ইচ্ছামতোই আমাকে চলতে হবে, এসবই পাগলের চিন্তা।' 

এরা হলো স্রোতের বিপরীতে চলা মোহমুক্ত মানুষ। পরিবেশ-পরিস্থিতির সংঘাতে~ বাস্তবের কষাঘাতে, মানুষের ভিতরের কদর্য রূপটি এদের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা দেওয়ার ফলে এদের মোহমুক্তি ঘটেছে। এদের কথাগুলোও আমাদের ভেবে দেখার বিষয়। 

একটি সন্তানকেই সঠিকভাবে লালন-পালন করার ক্ষমতা যাদের নেই, তারা যদি একাধিক সন্তানের জন্ম দেয়, আর সেইসব সন্তানের যদি চোখ ফুটে থাকে, সেক্ষেত্রে এরূপ কথা তো তাদের শুনতে হবেই। বংশানুক্রমে উত্তর প্রজন্মে সংক্রামিত হওয়ার মতো কঠিন রোগে (যথা গনোরিয়া সিফিলিসে) আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও যারা সন্তান উৎপাদনে বিরত থাকে না, তাদের তো শাস্তি পেতেই হবে।

স্রোতের টানে ভেসে চলা, জগতের মোহ-মায়ায় আচ্ছন্ন মানুষও কম নেই এখানে। তারা এই পৃথিবীর সবকিছুকেই সুন্দর মনোহর রূপে দেখে থাকে। অজস্র জীবনের দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা, হাহাকার তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। তাদের কাছে জীবনটা হলো শুধুই হাসি-মজা, আনন্দ উপভোগ করার জন্য।  তাদের কথা, 'আমার জন্মদাতা মা-বাবা-ই আমার ঈশ্বর! তাদের চরণে শতকোটি প্রণাম। তারা আমাকে জন্ম না দিলে, পৃথিবীর এই সুন্দর রূপ~ এতো সুখ-আনন্দ উপভোগ করতেই পারতাম না আমি।'

Comments

Popular posts from this blog

A highly effective way to prevent and defeat coronavirus has been discovered!

মহর্ষি মহামানস-এর আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্ব

ধর্ষণ : এক জ্বলন্ত সমস্যা এবং তার সমাধান